Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যসমূহ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রতণসম্পদে সমৃদ্ধ একটি জেলা। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের রাজধানী হিসেবে শিবগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও দর্শনীয় নিদর্শন হিন্দু শাসন আমলে বিশেষ করে সেন বংশের শেষ রাজাদের খননকৃত দিঘী ও সুলতানী আমলে মুসলিম সুলতানদের নির্মিত মসজিদই এ উপজেলার প্রধান ঐতিহাসিক স্থাপনা। তাছাড়া বৃটিশ আমলে স্থানীয় জমিদারদেরও কিছু স্থাপনা শিবগঞ্জে দেখা যায়। এই জেলার ঐতিহাসিক সহাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ছোট সোনা মসজিদ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিঃ মধ্যে নির্মিত), শিবগঞ্জ; দারসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা (১৪৭৯ খ্রিঃ), শিবগঞ্জ; ধনাইচকের মসজিদ (১৫ শতকে নির্মিত), শিবগঞ্জ; খঞ্জনদীঘির মসজিদ (১৫ শতকে নির্মিত), শিবগঞ্জ; দাখিল দরওয়াজা (১২২৯ খ্রিঃ), শিবগঞ্জ; শাহ সুজার কাছাড়ি বাড়ি (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিঃ মধ্যে নির্মিত), শিবগঞ্জ; তোহাখানা মসজিদ (১৬৩৬-১৬৫৮ খ্রিঃ মধ্যে নির্মিত), শিবগঞ্জ; শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রহঃ) এর মাজার (১৬৬৯ খ্রিঃ নির্মিত), শিবগঞ্জ; বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এর মাজার (সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে ১৯৭১ খ্রিঃ নির্মিত), শিবগঞ্জ; কানসাট রাজবাড়ি, শিবগঞ্জ; চাঁপাই জামে মসজিদ (৮৯৩ হিজরিতে নির্মিত), সদর উপজেলা; মহারাজপুরের প্রাচীন মসজিদ (মুঘল আমলে নির্মিত), সদর উপজেলা; মাঝপাড়া প্রাচীন মসজিদ (১৭৭৫ খ্রিঃ নির্মিত), সদর উপজেলা; রামচন্দ্রপুরহাটের নীলকুঠি (১৮৫৯-৬১ খ্রিঃ, নীল বিদ্রোহের সাক্ষী) সদর উপজেলা; বারঘরিয়া কাছাড়ি বাড়ি (বর্তমানে বিলুপ্ত), সদর উপজেলা; বারঘরিয়া ও মহারাজপুর মঞ্চ, সদর উপজেলা; জোড়া মঠ (নির্মাণকাল অজ্ঞাত), সদর উপজেলা; নওদা বুরতজ, গোমসতাপুর; এক গম্বুজ বিশিষ্ট পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, গোমসতাপুর; শাহপুর গড় (বাদশাহি আমলের রাজধানী সুরক্ষা বেষ্টনী), গোমসতাপুর; জাগলবাড়ি ঢিবি (৮ম শতাব্দী), ভোলাহাট; ছোট জামবাড়িয়া দারতস সালাম জামে মসজিদ, ভোলাহাট; বড়গাছী দক্ষিণ টোলা বাজার জামে মসজিদ, ভোলাহাট; রেশম কুটির ও চিমনি, ভোলাহাট; আলী শাহ্পুর মসজিদ, নাচোল; রাজবাড়ি, নাচোল; কেন্দুয়া ঘাসুড়া মসজিদ, নাচোল; কলিহার জমিদারবাড়ি, নাচোল; মল্লিকপুর জমিদারবাড়ি, নাচোল।

 

ছোট সোনা মসজিদঃ

ছোট সোনামসজিদ ‘সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন’ বলে আখ্যাত। এটি বাংলার রাজধানী গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর কোয়াটার্স এর তাহখানা কমপ্লেক্স থেকে অর্ধ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কোতোয়ালী দরওয়াজা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। বিশাল এক দিঘির দক্ষিণপাড়ের পশ্চিম অংশ জুড়ে এর অবস্থান। মসজিদের কিছু দূর পশ্চিমে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিপ্তর কর্তৃক কয়েক বছর পূর্বে নির্মিত একটি আধুনিক দ্বিতল গেষ্ট হাউস রয়েছে। গেষ্ট হাউস ও মসজিদের মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে একটি আধুনিক রাস্তা চলে গেছে। মনে হয় রাস্তাটি পুরনো আমলের এবং একসময় এটি কোতোয়ালী দরওয়াজা হয়ে দক্ষিণের শহরতলীর সঙ্গে গৌড়-লখনৌতির মূল শহরের সংযোগ স্থাপন করেছিল।

ছোট সোনামসজিদ

 

প্রধান প্রবেশ পথের উপরিভাগে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস-ই-মাজালিস মজলিস মনসুর ওয়ালী মুহম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। শিলালিপিতে নির্মানের সঠিক তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলি মুছে গেছে। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর নামের উল্লেখ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মসজিদটি তার রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোন এক সময় নির্মিত।


 

ছোট সোনামসজিদের প্রস্তর লিপি: 

মসজিদের দরজাগুলোর প্রান্তদেশ বলিষ্ঠ শোভাবর্ধক রেখা দিয়ে ঘেরা। কিন্তু খোদাই কাজটি অগভীর এবং অট্টালিকাটির খুব নিকটে না পৌছলে এ খোদাই কাজ চোখে পড়ে না। দরজাগুলোর মধ্যবর্তী কুলঙ্গীগুলোতেও রয়েছে একই অগভীর খোদাই। মধ্য দ্বারের উপরস্থ লিপিটির অনুবাদঃ ‘দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন যে, আল্লাহ ও বিচার দিনের উপর আর কাউকে ভয়করোনা।’ যারা আল্লাহর মসজিদ তৈরী করেন তারা শীঘ্রই পথ প্রদর্শিতদের অন্তর্ভূক্ত হবে এবং নবী (সাঃ) বলেন যে, আল্লাহর জন্য যে একটি মসজিদ নির্মাণ করে, তার জন্য অনুরূপ একটি গৃহ বেহেস্তে তৈরী করা হবে। এ মসজিদের নির্মাণ কার্য সুলতানগণের সুলতান, সৈয়দগণের সৈয়দ, পবিত্রতার উৎস, যিনি মুসলমান নর-নারীর উপর দয়া করেন, যিনি সত্য কথা ও সৎ কাজের প্রশংসা করেন, যিনি ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষক, সেই আলাউদ্দুনীয়া ওয়াদ্দীন আবুল মুযাফ্ফর হোসেন শাহ্ সুলতান আল হোসাইনী, (আল্লাহ তাঁর রাজ্য ও শাসন চিরস্থায়ী করেন) এর রাজত্বকালে সংঘটিত হয়। খালেছ ও আন্তরিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে ওয়ালী মনসুর, কর্তৃক জামে মসজিদ নির্মিত হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ইহকাল ও পরকাল উভয়স্থানে তাকে সাহায্য করেন। এর শুভ তারিখ হচ্ছে আল্লাহর রহমতের মাস রজবের ১৪ তারিখ। এর মূল্য এবং মর্যাদা বর্ধিত হোক।’’ এই লিপিটির মধ্যম লাইনে তিনটি শোভাবর্ধক বৃত্ত রয়েছে। প্রত্যেকটিরমধ্যে রয়েছে আল্লাহর নাম। মধ্যম বৃত্তটির মধ্যে রয়েছে ‘ইয়া আল্লাহ’ (ও আল্লাহ) ডানদিকে বৃত্তটির মধ্যে রয়েছে ‘ইয়া হাফিয’ ( ও রক্ষক) এবং বামদিকের বৃত্তটির মধ্যে ‘ইয়া রহিম’ (ও দয়াময়)। অলংকরণের ক্ষেত্রে যে সোনালি গিল্টির ব্যবহার থেকে এর ‘সোনা মসজিদ’ নামকরণ হয়েছে তা এখন আর নেই।মসজিদ প্রাঙ্গণের চতুদিকে পূর্বে একটি বহির্দেয়াল ছিল। পূর্ব পশ্চিমে ৪২ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪৩ মিটার লম্বা এ বহির্দেয়ালের পূর্বদিকের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ফটক ছিল। শুধু ফটকটি ছাড়া সমগ্র বহির্দেয়াল এখন সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে স্থানে স্থানে এখনও এর চিহ্ন সুস্পষ্ট। বর্তমানে মূল চৌহদ্দি দেওয়ালের স্থলে কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়েছে। স্থানীয় ভাবে জানা যায় যে, ফটকের নিকটে এবং দিঘির দক্ষিণপাড়ে এক সময় সোপানবিশিষ্ট একটি পাকা ঘাট ছিল।

মসজিদটি ইট ও পাথরে নির্মিত। এ মসজিদের মূল ইমারত আয়তাকার এবং বাইরের দিকে উত্তর-দক্ষিণে ২৫.১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫.৯ মিটার। চারটি দেওয়ালই বাইরের দিকে এবং কিছুটা অভ্যন্তরভাগেও গ্রানাইট পাথরখন্ডের আস্তরন শোভিত। ১৮৯৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে ধ্বংসলীলার পর সংস্কার কাজের সময় পশ্চিম দেয়ালের দক্ষিণ অংশে পাথরের আস্তরন অপসারিত হয়েছে। মসজিদের বাইরের দিকে চার কোণে চারটি বহুভূজাকৃতির বুরুজের সাহায্যে কোণগুলিকে মজবুত করা হয়েছে। এ বহুভুজ বুরুজের নয়টি অংশ বাইরে থেকে দেখা যায়। পেছন দেয়ালের মধ্যবর্তীস্থলে কেন্দ্রীয় মিহরাবের বাইরের দিকে আয়তাকার একটি বর্ধিত অংশ রয়েছে। কার্নিসগুলো ধনুকের মতো বাঁকানো এবং ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের জন্য ছাদের কিনারায় পাথরের নালি বসানো আছে। মসজিদের পূর্বদিকের সম্মুখভাগে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। পূর্ব দেয়ালের খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার বরাবর পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তরে রয়েছে পাঁচটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব। অধিকাংশ মিহরাবের পাথর সরিয়ে নেয়ার ফলে এখন সমগ্র পশ্চিম দেওয়াল অনাবৃত হয়ে পড়েছে; অথচ এক সময় এ দেয়ালই ছিল মসজিদের সর্বাপেক্ষা সুদৃশ্য অংশ।

মসজিদের ২১.২ মি Í১২.২ মি পরিমাপের অভ্যন্তরভাগ প্রতি সারিতে চারটি করে দুসারি প্রস্তর স্তম্ভ দ্বারা উত্তর দক্ষিণে লম্বা তিন স্তরে বিভক্ত। একটি বিস্তৃত কেন্দ্রীয় নেভ স্তরগুলোকে সমান দুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রতি ভাগে রয়েছে ৩.৫ মিটার বাহুবিশিষ্ট ছয়টি সমান বর্গাকার ইউনিট। মসজিদের অভ্যন্তরভাগে তাই মোট পনেরোটি ইউনিট রয়েছে যার মধ্যে তিনটি আয়তাকার ইউনিট চৌচালা খিলান ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত। বাকি বারোটি বর্গাকৃতি ইউনিটের প্রত্যেকটি উল্টানো পানপাত্র আকৃতির গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। এগুলোর সবই স্বতন্ত্র পাথরের স্তম্ভ ও ভবনের সঙ্গে যুক্তস্তম্ভ শীর্ষে বসানো বিচ্ছুরিত খিলানের উপর স্থাপিত। কিন্তু ইউনিটগুলোর খিলানের মধ্যবর্তী উপরের কোণগুলি গম্বুজ বসানোর উপযোগী করার জন্য করবেল পদ্ধতিতে ইটের পেন্ডেন্টিভ দ্বারা বন্ধ করা হয়েছে। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে উপরিভাগে দোতলার কায়দায় নির্মিত একটি রাজকীয় গ্যালারি রয়েছে। গ্যালিরিটি এখনও ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় বিদ্যমান। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল গ্যালারির প্রবেশপথ। দরজার সঙ্গে সংযুক্ত একটি সোপানযুক্ত প্লাটফর্ম হয়ে গ্যালারিতে পৌঁছাত। গ্যালারির সম্মুখভাগে রয়েছে একটি মিহরাব।

মসজিদের অলংকরণের ক্ষেত্রে খোদাইকৃত পাথর, ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের গিল্টি ও চকচকে টালি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এগুলোর ভেতর প্রাধান্য পেয়েছে খোদাইকৃত পাথর। ক্রাইটন ও কানিংহাম মসজিদটির ছাদের উপর পনেরোটি গম্বুজ ও খিলান ছাদের সবগুলোই গিল্টি করা দেখতে পান। কিন্তু বর্তমানে গিল্টির কোন চিহ্ন নেই। পাথর খোদাইয়ের নকশার ধরন নির্বাচন করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট পরিসরের উপযোগিতা অনুযায়ী। যেমন, প্যানেলের কিনারগুলিতে করা হয়েছে লতাপাতার নকশা এবং এদের অভ্যন্তরভাগে হিন্দু আমলের শিকল ও ঘন্টার মোটিফ অনুসরনে বিভিন্ন ধরনের ঝুলন্তরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। খিলানের স্প্যান্ড্রিল ও ফ্রেমের উপরের স্থানগুলি আকর্ষনীয় অলংকরণরীতিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে খোদাই করা গোলাপ দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। গম্বুজ ও খিলান ছাদের অভ্যন্তর ভাগে পোড়ামাটির ফলক দিয়ে অলংকৃত; তবে খিলান ছাদের অলংকরণ করা হয়েছে স্থানীয় কুঁড়েঘরের বাঁশের ফ্রেমের অনুকরণে। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় অলংকরণ হলো কোণের বুরুজের খোদাইকৃত পাথরের বেষ্টনী এবং দ্বারপথ ও ফ্রেমের উপরে বসানো পাথরের কার্নিস ও অলংকরণ রেখা। উল্লেখ্য, সম্মুখের সবগুলি খিলানপথ ও মিহ্রাবের খিলানগুলি ছিল খাঁজবিশিষ্ট এবং এগুলো অনেকাংশে এ মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল।

মসজিদের প্রবেশদ্বারের মতোই পূর্ব দিকের ফটকে একসময় বিভিন্ন নকশা খোদাইকৃত প্রস্ত্তর ফলকের আস্তরণ ছিল। কিন্তু এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত কিছু গোলাপ নকশা ছাড়া এসব অলংকরণের তেমন কিছই এখন আর নেই। ফটকের ১৪.৫ মিটার পূর্বদিকে একটি পাথরের প্লাটফর্ম রয়েছে যার আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪.২ মিটার, পূর্ব-পশ্চিমে ৬.২ মিটার এবং উচ্চতা ১ মিটার। এর চার কোনে রয়েছে একটি করে প্রস্ত্তর স্তম্ভ। প্লাটফর্মের পরে কয়েকটি উর্ধ্বমুখী আয়তাকার ধাপ আছে এবং এ ধাপসমূহের পরিধি উপরের দিকে ক্রমশ হ্রাস হয়ে এসেছে। দুটি সমাধিতে রয়েছে কুরআনের আয়াত ও আল্লাহর কতিপয় নাম সম্বলিত অগ্রভাগ সরু পিপাকৃতির পাথরের সমাধিফলক। এখানে কারা সমাহিত আছেন তা সঠিক জানা যায়নি। কানিংহাম সমাধি দুটিকে মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহম্মদ ও তার পিতা আলীর বলে মনে করেন। ছোট সোনা মসিজিদের দৃষ্টিনন্দন রূপ অনেকটা হ্রাস পেলেও অদ্যাবধি এটি গৌড়-লখনৌতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইমারত এবং এ এলাকায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য সর্বাধিক কাঙ্ক্ষিত নিদর্শন।

 

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধি:

মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দুটি আধুনিক কবর রয়েছে। কবর দুটি উত্তর-দক্ষিণে ৪.১ মিটার পূর্ব-পশ্চিমে ৪.৭ মিটার এবং ১.৩ মিটার উঁচু ইটের প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। কবর দুটি বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হক-এর।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বরিশালের রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৭ সালের ৫ অক্টোবর কাকুলপাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে যোগদান করেন। নিষ্ঠার সাথে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর ১৯৬৮ সালের ২ জুন কমিশন প্রাপ্ত হন। ছয় মাস চাকুরী করার পর তিনি রিসালপুরস্থ মিলিটারি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ যোগদান করেন এবং সুদীর্ঘ ১৩ মাসের বেসিক কোর্সে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এরপর সেখান হতে বোম্ব ডিসপোজাল কোর্স করেন এবং কোর অব ইঞ্জিনিয়ারস এর একজন সুদক্ষ অফিসার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনী যখন বাংলাদেশএক ধ্বংসযজ্ঞ ও পাশবিক অত্যাচারে লিপ্ত ছিল, তখন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কারাকোরামের বন্ধুর পার্বত্য সীমান্ত রক্ষীদের দৃষ্টি এড়িয়ে শিয়ালকোট সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করেন। ভারত হতে পরে তিনি বাংলদেশ সীমান্তে পৌঁছেন। শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নির্দেশে রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত এলাকার ৭ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে কাজ করছিলেন। তার যোগ্য অধিনায়কত্বে মুক্তিবাহিনী এক চরম বিভীষিকারূপে হানাদার বাহিনীর সকল স্তরের সৈনিকদের মধ্যে মহাত্রাসের সঞ্চার করেছিল। সিংহ শক্তিতে বলিয়ান মুক্তিসেনারা ঝাপিয়ে পড়লে শত্রুদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটিগুলো একের পর এক পতন ঘটতে থাকে। তাদের আক্রমণ এত প্রবল ও ত্রাস সৃষ্টিকারী ছিল যে, একবার একটি শত্রু লাইনের উপর হামলা চালাবার পূর্ব মুহুর্তে প্রায় সহস্রাধিক শত্রুসেনা প্রাণের ভয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছেড়ে চলে যান। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মহানন্দা নদী অতিক্রম করে শত্রুসৈন্যদের ধ্বংস করার জন্য নবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হন। ১৪ ডিসেম্বর তিনি শত্রুদের কঠিন ব্যুহ ভেদ করবার জন্য দুর্ভেদ্য অবস্থানগুলো ধ্বংস করছিলেন, যখন আর একটি মাত্র শত্রু অবস্থান বাকী রইল এমন সময় মুখোমুখি সংঘর্ষে বাংকার চার্জে শত্রুর বুলেটের আঘাতে বাংলার এই সূর্য সৈনিক শাহাদাৎ বরণ করলেন। দৃঢ় অথচ বজ্রশপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে দুটি চোখ স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরীর মত সদা জাগ্রত থেকে ভবিষ্যতের স্বাধীন সোনালী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিল তা স্তিমিত হয়ে গেল।১৫ ডিসেম্বর শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গনে আনা হয়। অসংখ্য স্বাধীনতা প্রেমিক জনগণ, ভক্ত মুক্তিযোদ্ধা, অগণিত মা-বোনের নয়ন জলের আর্শীবাদে সিক্ত করে তাকে এখানে সমাহিত করা হয়।

 

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেনমহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এঁর সমাধি

 

দারসবাড়ী মসজিদ ও মাদ্রাসাঃ 

ছোট সোনামসজিদ ও কোতোয়ালী দরজার মধ্যবর্তী স্থানে ওমরপুরের সন্নিকটে দারসবাড়ী অবস্থিত। পুরুষানুক্রমে স্থানীয় জনসাধারণ এই স্থানকে ‘দারসবাড়ী’ বলে থাকেন। বর্তমানে এই স্থান পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। দর্স অর্থ পাঠ। সম্ভবতঃ একসময় মসজিদ সংলগ্ন একটি মাদ্রাসা ছিল এখানে। ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের সময় মুনশী এলাহী বখশ কর্তৃক আবিস্কৃত একটি আরবী শিলালিপি অনুযায়ী (লিপি-দৈর্ঘ্য ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি, প্রস্থ ২ফুট ১ ইঞ্চি) ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে (হিজরী ৮৮৪) সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের রাজত্বকালে তাঁরই আদেশক্রমে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইট নির্মিত এই মসজিদের অভ্যন্তরের আয়তক্ষেত্র দুই অংশে বিভক্ত।

দারসবাড়ী মসজিদ

 

এর আয়তন ৯৯ ফুট ৫ ইঞ্চি, ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চি। পূর্ব পার্শ্বে একটি বারান্দা, যা ১০ ফুট ৭ ইঞ্চি। বারান্দার খিলানে ৭টি প্রস্ত্তর স্তম্ভের উপরের ৬টি ক্ষুদ্রাকৃতি গম্বুজ এবং মধ্যবর্তীটি অপেক্ষাকৃত বড় ছিল। উপরে ৯টি গম্বুজের চিহ্নাবশেষ রয়েছে উত্তর দক্ষিণে ৩টি করে জানালা ছিল। উত্তর পশ্চিম কোণে মহিলাদের নামাজের জন্য প্রস্তরস্তম্ভের উপরে একটি ছাদ ছিল। এর পরিচয় স্বরূপ এখনও একটি মেহরাব রয়েছে। এতদ্ব্যতীত পশ্চিম দেয়ালে পাশাপাশি ৩টি করে ৯টি কারুকার্য খচিত মেহরাব বর্তমান রয়েছে। এই মসজিদের চারপার্শ্বে দেয়াল ও কয়েকটি প্রস্তর স্তম্ভের মূলদেশ ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই । এ মসজিদটিও বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যের কীর্তির একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এখানে প্রাপ্ত তোগরা অক্ষরে উৎকীর্ণ ইউসুফি শাহী লিপিটি এখন কোলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। জেনারেল ক্যানিংহাম তার নিজের ভাষাতে একে দারসবাড়ী বা কলেজ বলেছেন। এ ঐতিহাসিক কীর্তির মাত্র কয়েকগজ দূরে ভারতীয় সীমান্ত।

দারসবাড়ী মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ

 

দারসবাড়ী মসজিদের প্রস্তর লিপিঃ

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে এ স্থানে একটি জঞ্জাল স্ত্তপের নিচে মুন্সী এলাহী বখশ ১১ফুট ৩ ইঞ্চি ও ২ ফুট ১ ইঞ্চ উচু একটি তোঘরা লিপি প্রাপ্ত হন। এটা এখন কলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। নম্বর-৩১৩৯। লিপিটির বিপুল দৈর্ঘের কারণে একে দু’ভাগ করতে হয়েছে। লিপির অর্থ হচ্ছে-

‘‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন- নিশ্চয়ই সব মসজিদ আল্লাহর, সুতরাং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না।’ নবীও বলেছেন, আল্লাহর জন্য যে একটি মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তার জন্য বেহেস্তে অনুরূপ একটি প্রাসাদ তৈরী করবেন। এই জামে মসজিদ ন্যায় পরায়ণ ও মহান সুলতান, জনগণ ও জাতি সমূহের প্রভু, সুলতানের পুত্র সুলতান, তাঁর পুত্র সুলতানের পুত্র শামসুদ্দুনীয়া ওয়াদ্দীন আবুল মুজাফ্ফর ইউসুফ শাহ সুলতান, পিতা বরবক শাহ সুলতান, পিতা মাহমুদ শাহ সুলতান কর্তৃক নির্মিত। আল্লাহ তার শাসন ও সার্বভৌমত্ব চিরস্থায়ী করুন এবং তার উদারতা ও উপচিকীর্ষা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক। তারিখ ৮৮৪ হিঃ’’

 

খঞ্জনদীঘির মসজিদঃ

 

দারসবাড়ী মসজিদের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত বল্লাল সেন খননকৃত বালিয়া দীঘির দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে পূর্বদিকেকিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ে খঞ্জনদীঘির মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। একটি প্রাচীন জলাশয়ের পাশেই এ ধ্বংসাবশেষটি অবস্থিত। খঞ্চনদীঘির মসজিদটি অনেকের নিকট খনিয়াদীঘির মসজিদ নামে পরিচিত। আবার অনেকে একে রাজবিবি মসজিদও বলে থাকেন। বহুকাল ধরে মসজিদটি জঙ্গলের ভেতর পড়েছিল। কিছুকাল আগে জঙ্গল কমে গেলে মসজিদটি মানুষের চোখে পড়ে। কিন্তু ইতোমধ্যে মসজিদটি প্রায় শেষ অবস্থায় এসে পৌছেছিল।

খঞ্জনদীঘির মসজিদ

 

প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ এখন এটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। বর্তমানে মসজিদটির একটি মাত্র গম্বুজ ও দেয়ালের কিছু কিছু অংশ কোন রকমে টিকে আছে। এগুলোর অবস্থাও খুব জীর্ণ। পূর্বে এই মসজিদের আয়তন ছিল ৬২Í৪২ ফুট। গম্বুজটির নিচের ইমারত বর্গের আকারে তৈরী। এই বর্গের প্রত্যেক বাহু ২৮ ফুট লম্বা। এটি মাঝের গম্বুজ। বড় কামরার সামনের দিকে (পূর্ব) একটি বারান্দা ছিল। ইটের তৈরী এ মসজিদের বাইরে সুন্দর কারুকাজ করা ছিল। যার নমুনা খুব সামান্য হলেও রয়েছে। খঞ্চনদীঘির মসজিদ কখন নির্মিত হয়েছিল এবং কে নির্মাণ করেছিলেন সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তবে মসজিদ তৈরীর নমুনা দেখে পন্ডিতেরা অনুমান করেন যে এটি পনেরো শতকে নির্মিত হয়েছিল।

 

ধনাইচকের মসজিদঃ

 

খঞ্জনদীঘি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের একটু দুরেই রয়েছে আর একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। এই মসজিদের নাম ধনাইচকের মসজিদ। মসজিদটির পশ্চিম ও উত্তর দেয়ালের কিছু অংশ এবং স্তম্ভের কিছু অংশ, এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আর রয়েছে কয়েকটি স্তম্ভের কিছু কিছু, এগুলো পাথরের তৈরী। অনেককাল আগের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে জানা যায় যে, মসজিদটিতে ৩টি গম্বুজ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালের গবেষণায় দেখা গেছে এতে ৬টি গম্বুজ ছিল। মেহরাবে ছিল অতি সুন্দর লতাপাতা ফুলের কাজ। এ মসজিদটিও ১৫ শতকে নির্মিত বলে পন্ডিতেরা অনুমান করেন। তবে এর নির্মাতা কে এ সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায়নি।

 

 

 

চামচিকা মসজিদঃ

চামচিকা মসজিদের নামকরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না। তবে বর্তমান ভারতে অবস্থিত বড় চামচিকা মসজিদের আদলেই এটি তৈরী। দারসবাড়ী মসজিদের মতই পোড়ামাটি ইট ও কারুকার্য খচিত এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর দেয়ালের পরিধি এত মোটা যে চৈত্র মাসের প্রচন্ড গরমে এর ভিতরে শীতল পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। এর মূল গম্বুজটি অতি সুন্দর। এই মসজিদের পূর্বে ৬০ বিঘা আয়তনের খঞ্জন দিঘী নামে একটি বড় দিঘী রয়েছে যার পাড়ে সিড়ি বাঁধা ঘাট ছিলমুসল্লীদের ওজু করার জন্য।

চামচিকা মসজিদ

 

তিন গম্বুজ মসজিদ ও তাহখানাঃ

 

শিবগঞ্জ উপজেলা ফিরোজপুরস্থিত শাহ্ নেয়ামতউল্লাহ (রহঃ) প্রতিষ্ঠিত তদীয় সমাধি সংশ্লিষ্ট তিন গম্বুজ মসজিদটি মোঘল যুগের একটি বিশিষ্ট কীর্তি। এতে ৩টি প্রবেশ পথ এবং ভেতরে ৩টি মেহরাব রয়েছে। মসজিদের ভেতর ও বাইরে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কারুকার্য নেই। দেয়ালে কয়েকটি তাক আছে। স্থানীয় জনসাধারণ এই মসজিদে নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করে থাকেন। এই মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে সুলতান শাহ সুজা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দ্বিতল ইমারত মোঘল যুগের আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কীর্তি। ইট নির্মিত ইমারতটি তোহাখানা নামে প্রসিদ্ধ। কথিত আছে বঙ্গ সুলতান শাহ সুজা তাঁর মোরশেদ হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহর উদ্দেশ্যে (রাজত্বকাল ১৬৩৯-৫৮ খ্রিঃ) শীতকালীন বাসের জন্য ফিরোজপুর তাপনিয়ন্ত্রণ ইমারত হিসেবে এ ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। সময়ে সময়ে শাহ সুজাও এখানে এসে বাস করতেন। এর দৈর্ঘ্য উত্তর দক্ষিণে ১১৬ ফুট ও প্রস্থে ৩৮ ফুট। এতে ছোট বড় অনেক কামরা ও উভয় পার্শ্বে বারান্দা ছিল।

তিন গম্বুজ মসজিদ

 

জনশ্রুতি আছে যে-শাহ সুজা যখন ফিরোজপুরে মোরশেদ শাহ নেয়ামতউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসতেন তখন উক্ত ইমারতের মধ্যবর্তী সুপ্রশস্ত কামরাটিতে বাস করতেন। গৌড়ের প্রাচীন কীর্তির মধ্যে এই শ্রেণীর ইমরাত এই একটিই পরিলক্ষিত হয়। কড়িকাঠের উপর খোয়া ঢালাই করে যার ছাদ ও কোঠা জমাট করা হয়েছিল। উল্লেখিত মসজিদ ও তাহখানার নিকটস্থ সরোবর দাফেউল বালাহর তীরে অবস্থিত। এই দুই ইমারত হতে দুইটি সিড়ি সরোবরের তলদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্বতীর হতে এই ইমারত দুটোর দৃশ্যাবলী খুবই মনোরম।

 

 

তাহখানা কমপ্লেক্সঃ 

 

তাহখানা পারসিয়ান শব্দ যার আভিধানিক অর্থ ঠান্ডা ভবন বা প্রাসাদ। গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর এলাকায় একটি বড় পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত ভবন কাঠামোটি ঐতিহ্যগতভাবে তাহখানা নামে পরিচিত। ভবনটির উত্তর-পশ্চিমে আরও দুটি কাঠামো রয়েছে নিকটস্থটি একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এবং একটু উত্তরে অবস্থিত অপরটি ভল্টেড বারান্দা ঘেরা একটি গম্বুজ সমাধি। যেহেতু ভবনগুলো একই সময় একটি বিশেষ উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল, সেহেতু সবগুলো ভবনকে একত্রে একটি একক ইউনিট বা একটি কমপ্লেক্স হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে বর্তমানে এসব ধ্বংসপ্রাপ্ত। কে এই কমপ্লেক্সের নির্মাতা তা নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। তবে ভবনগুলোর স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট্য, সুলতানি রীতির সৌধসমূহের মাঝে বিষম বৈশিষ্ট্যের মুঘলরীতির প্রয়োগ এবং সমসাময়িক ও পরবর্তী ঐতিহাসিক বিবরণ ইঙ্গিত করে যে এর নির্মাতা মুগল সুবাহদার শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিঃ) । তিনি সুফী সাধক শাহ নেয়ামতউল্লাহ ওয়ালীর প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ মাঝে মাঝে গৌড়-লখনৌতি যেতেন এবং তিনি সেখানে অবস্থানও করতেন। রাজমহলেই ছিল শাহ সুজার রাজধানী, যা গৌড় থেকে খুব দূরে নয়। তবে প্রায়ই গৌড়ে তার ভ্রমণ এবং সেখানে অবস্থিত লুকোচুরি দরওয়াজা নামে জাকজমকপূর্ণ মোঘল তোরণ এ যুক্তিটিকে আরও বেশি অকাট্য করে তুলেছে। খুব সম্ভবত শাহ সুজা দরবেশের খানকাহ হিসেবে এই ছোট্ট প্রাসাদটি এবং এর সংলগ্ন মসজিদ ও সমাধিসৌধটি নির্মাণ করেন। সমাধিটি সম্ভবত দরবেশের (মৃত্যু ১৬৬৪ অথবা ১৬৬৯ খ্রিঃ) অন্তিম শয়নের জন্য পূর্বেই নির্মিত হয়েছিল।

তাহখানা কমপ্লেক্স

 

দ্বিতল ভবনটি মূলত ইট নির্মিত। তবে দরজার চৌকাঠের জন্য কালো পাথর এবং সমতল ছাদের জন্য কাঠের বীম ব্যবহৃত হয়েছে। পশ্চিম দিক থেকে ভবনটিকে দেখলে একতলা মনে হয়, পূর্বদিক থেকে অবশ্য দ্বিতল অবয়বই প্রকাশ পায়, যার নিচতলার কক্ষগুলি পূর্বদিকে বর্ধিত এবং খিলানপথগুলি উত্থিত হয়েছে সরাসরি জলাশয়টি থেকে। ভবনের দক্ষিণ পার্শ্বে রয়েছে একটি গোসলখানা যেখানে পানি সরবরাহ হতো একটি অষ্টভুজাকৃতির চৌবাচ্চার মাধ্যমে জলাশয় থেকে। উত্তর পার্শ্বে একটি ছোট পারিবারিক মসজিদ অবস্থিত এর পেছনে রয়েছে একটি উন্মুক্ত কক্ষ যেটি একটি অষ্টভুজাকার টাওয়ার কক্ষের সাথে সংযুক্ত ছিল। এ টাওয়ার কক্ষটি সম্ভবত ধ্যানের জন্য ব্যবহৃত হতো। অষ্টভুজাকার টাওয়ারটি সমস্ত কমপ্লেক্সটিতে ভারসাম্য প্রদান করেছে। প্রাসাদটি প্লাস্টার করা এবং তা খোদাইকৃত। এসব অলংকরণ রীতি মোঘল আমলের। তাহখানা কমপ্লেক্সটি সুলতানি যুগের নগরে মুগল রীতির স্থাপত্য নিদর্শনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের স্থাপত্য বাংলায় প্রথম। এ ধরনের কমপ্লেক্সের সূত্রপাত হওয়ার পর ঢাকা ও মুর্শিদাবাদে এরূপ প্রাসাদ, মসজিদ অথবা সমাধিসৌধ সম্বলিত কমপ্লেক্স একটি প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়।

 

শাহ্ নেয়ামতউল্লাহ (রহঃ) ও তাঁর মাজারঃ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে (গৌড়ের পূর্বাঞ্চলে) ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব যারা বহন করেছিলেন তাদের মধ্যে স্বনাম খ্যাত সাধক হযরত শাহ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহ (রহঃ) অন্যতম। সুলতান শাহ সুজার রাজত্বকালে (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিঃ) তিনি দিল্লী প্রদেশের করোনিয়ার নামক স্থান থেকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে নানা স্থান ভ্রমন করে রাজমহলে এসে উপস্থিত হন। তার আগমনবার্তা জানতে পেরে শাহ সুজা তাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান এবং তার নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। পরে তিনি গৌড়ের উপকন্ঠে (শিবগঞ্জ উপজেলার) ফিরোজপুরে স্থায়ীভাবে আস্তানা স্থাপন করেন। দীর্ঘদিন এতদঞ্চলে তিনি সুনামের সঙ্গে ইসলাম প্রচার করে ফিরোজপুরেই ১০৭৫ হিজরী (১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে) মতান্তরে ১০৮০ হিজরীতে (১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে) সমাধিস্থ হন। পারস্য দেশীয় একটি বিবরণীতে হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা হয়েছে। তিনি একজন জবরদস্ত আলেম ও আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন। ষোড়শ শতকের শ্রেষ্ঠ আওলিয়াগণের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। তাহখানা প্রাসাদটি শাহ সুজা, শাহ নেয়ামতউল্লাহর বসবাসের জন্য প্রদান করেন। পরে তিনি সেখানে একটি ৩ গমবুজ মসজিদ নির্মান করেন এখনও তা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

 

 

শাহ্ নেয়ামতউল্লাহ (রহঃ) এঁর মাজার

 

 

হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধর ও পুরুষানুক্রমিক ওলী ছিলেন। তিনি হাকিকাত ও মারেফাতের শ্রেষ্ঠ কামেল দরবেশ ছিলেন। তাঁর মত একজন ধর্মনিষ্ঠ আউলিয়া যাতে আজীবন নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম ও মুসলমানের সেবা এবংরাজ্যের উন্নতি করতে পারেন -সেজন্য বাদশাহ আলমগীর মহিউদ্দিন আওরঙ্গজেব সুবায়ে বাঙলা সরকার জান্নাতাবাদে পরাগণে ‘দারাশাকে’ ৫,০০০/- টাকা আয়ের সম্পত্তি তার ও তার বংশধরদের ভরণপোষণের জন্য দান করেন। তিনি প্রায় ৩৩ বছর এই সম্পত্তির আয় থেকে এই মসজিদ ও খানকার যাবতীয় খরচাদি নির্বাহ করে গেছেন। তার মৃত্যুর পরও অনেকদিন পর্যন্ত সম্পত্তির আয় হতে খানকা ও মসজিদের জন্য ব্যয় হতো।

 

সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরমানটি নিম্নরূপঃ‘‘যেহেতু (সুলতানের) উদার ও ধার্মিক অন্তরে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ এবং নবীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সাঈদদের আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছা পূরণের অভিলাষ গভীরভাবে বদ্ধমূল, সেজন্য এই শুভ সময়ে সাঈদ ও আমীরবৃন্দের এবং যার হাকিকাত ও মারিফাতের (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) সাথে সুপরিচিত, তাদের আশ্রয়স্থল শাহ নেয়ামতউল্লাহর প্রতি রাজকীয় দানশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। কল্যাণ ও দয়ার আশ্রয় থেকে এই মর্মে একটি মহান ফরমান জারী করা হয়েছে যে, শরৎকালীন ফসলের শুরু থেকে বাংলা সুবার (প্রদেশ) জান্নাতাবাদ সরকারের দরসড়ক পরগানা থেকে ৫০০০/- টাকা তার বংশধরগণের ভরণপোষণের জন্য মঞ্জুর করা হলো। যাতে তিনি আরাম আয়েশে জীবন যাপন করতে পারেন এবং সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করতে পারেন। সমস্ত রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ এই রাজকীয় আদেশ স্থায়ী বিবেচনা করবেন এবং সে পরগণার যে সব মৌজার আয় ৫,০০০/- টাকা সেগুলো তার নিকটে তার ভরণপোষণের নিমিত্তে হস্তান্তর করতে হবে। পরলোকগত সুলতানের এটি সাবেক ফরমান দ্বারা দরবেশকে যে মদদ-ই-মাশের (খরচ) মঞ্জুরী দেয়া হয়েছিল, উপরোক্ত অর্থ এর অতিরিক্ত বিবেচনা করতে হবে। ফরমানের মধ্যে উল্লেখ নেই এমন কিছু (অর্থাৎ মঞ্জুরী) বাতিল বলে গণ্য করতে হবে। মূল ফরমানটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই ফরমানটি যা রবিউস সানি ১০৭৭ হিজরীতে প্রতিপালিত হয়েছে বলে সম্রাটকে জানানো হয় এবং শাহজাহানের ১৬ই রবিউস সানি, ১০৪৩ হিজরী তারিখে পূর্বতন ফরমানটি এই উভয় ফরমানের সত্যায়িত অনুলিপি মালদহ কালেকটরেটে পাওয়া যায়। গৌড়ের ফিরোজপুরে যে, পতিত জমি সৈয়দ শাহ নেয়ামতউল্লাহ চাষের অধীনে এনেছিলেন এবং যার আয় থেকে তিনি সেখানে তার নির্মিত একটি মসজিদ ও খানকার ব্যয় নির্বাহ করতেন, পূর্বতন আদেশটি দ্বারা তার উপর যে কোন ধরণের কর আরোপে নিষিদ্ধ করা হয়। ফরমান দুটির তারিখ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, দরবেশ অন্তত ৩৩ বছর ফিরোজপুরে বসবাস করেন এবং তার মৃত্যুর তারিখ ১০৮০ হিজরী।

 

শাহ নেয়ামতউল্লাহর সমাধিঃ

 

হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহর মাজার শরীফ শিবগঞ্জ উপজেলার তোহাখানায় অবস্থিত। বার দরজা বিশিষ্ট চতুস্কোনায়তন তার সমাধিটি। প্রত্যেক পাশে ২/৩ টি করে দরজা আছে। এখানে যে লিপিটি আছে তা হোসেন শাহী যুগের একটি আরবী লিপি। পরবর্তীকালে তা স্থাপন করা হয়েছে। এই সমাধি প্রাঙ্গণে আরো কয়েকজন সাধক, তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গের সমাধি রয়েছে। হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহর সমাধি প্রাঙ্গন বৃক্ষশোভিত ও ইটের প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত। প্রতিদিনই বহুলোক তার মাজার দর্শন করে কৃতার্থ হন।

 

পহেলা মহরম হযরত শাহ নোয়ামতউল্লাহর জন্ম ও মৃত্যুর দিন বলে পরিচিত। এই দিনে প্রতিবছরই এখানে ‘উরস পালন’ করা হয়ে থাকে। এছাড়া ভাদ্র মাসের শেষ শুক্রবার এখানে অন্য একটি উরস পালন করা হয়। এ দিনই অধিকাংশ লোক এখানে জমায়েত হয়ে থাকেন। এ দিনেরই ফজিলত বেশি বলে অনেকের ধারনা। হযরত এদিনে ইসলাম প্রচারের জন্য সর্বপ্রথম গৌড় নগরীতে পদার্পন করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবারের দিন আসরের নামাজের পর সারারাত ব্যাপী ‘জেকের’ অনুষ্ঠিত হয়। উরস কমিটির পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মিলাদ শরীফ পাঠ করান হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসককে পদাধিকার বলে সভাপতি করে একটি ‘মাজার পরিচালনা কমিটি‘ গঠিত রয়েছে। এতে ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ী, সরকারী কর্মচারী ছাড়াও বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সদস্য রয়েছেন। শুক্রবার বাদ জুম্মা হযরতের মাজারে চাদরপশী বা গিলাফ পরানো হয়। এই চাদর প্রদান করেন পীর সাহেবের বংশধর নবাবগঞ্জ নিবাসী আলহাজ্ব শাজাহান আলী । তিনি পীর সাহেবের কন্যা কাদিরণ নেসার বংশধর।

 

কোতোয়ালীদরওয়াজা :

 

নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ ‘কোতওয়াল’ এর অনুকরণে নামকরণ করা হয়েছে। এ নগরপুলিশ (কোতওয়াল) গৌড় নগরীর দক্ষিণ দেয়াল রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। আবিদ আলীর বর্ণনানুযায়ী (Memoirs of Gaur and Pandua, Calcutta, 1931), প্রবেশপথের মধ্যবর্তী খিলানের উচ্চতা ৯.১৫ মিটার এবং প্রস্থ ৫.১০ মিটার। তার বিবরণে প্রবেশপথের পূর্ব ও পশ্চিমদিকের সচ্ছিদ্র প্রাচীরের কথা উল্লেখ আছে। এ ছিদ্রগুলি দিয়ে শত্রুর ওপর গুলি বা তীর ছোড়া হতো। আবিদ আলীর মতে, অভ্যন্তর ও বহির্ভাগ উভয় পার্শ্বের সম্মুখভাগে ক্রমঢাল বিশিষ্ট অর্ধবৃত্তাকার বুরুজ ছিল। বর্তমানে সারিবদ্ধ খরছিদ্র সম্বলিত বিশাল উত্তল পরিলেখসহ বহিস্থ বরুজের আংশিক দেখা যায়। বুরুজগুলির পার্শ্বের প্রতিরক্ষা প্রাচীর এখনও বিদ্যমান এবং তা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিম প্রাচীরটি নদী পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে, আর পূর্ব প্রাচীরটি ভারতীয় সীমান্তের অভ্যন্তরে কিছুদুর গিয়ে পৌছেছে। এরপর এ প্রাচীর বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে উত্তরমুখী হয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেছে। পুরু মাটির দেয়াল দেখেই বোঝা যায়, নগরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তখন কত মজবুত ছিল। প্রবেশপথের খিলানগুলোর ভেতর ও বাহিরে উভয় পার্শ্বই কারুকার্যমন্ডিত প্যানেলে শোভিত এবং এ প্যানেলের অভ্যন্তরে আছে ঝুলন্ত মোটিফ। এসব প্যানেলের কিছু কিছু এখনও টিকে আছে।

 

কোতোয়ালী দরওয়াজা

 

 

প্রাচীন গৌড়ের রাজধানীতে প্রবেশ করতে হলে দক্ষিণ ‘নগর উপকন্ঠে’র অধিবাসীদের এই তোরণ অতিক্রম করতে হতো। নগরদূর্গের অধিবাসীগণের দক্ষিণমুখী পথও ছিল এটিই। এর উপরের খিলান বহুদিন আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এই তোরণটির উচ্চতা ৩১২ ফুট বিস্তার ১৬ ফুট। প্রবেশপথের দৈর্ঘ্য ১৭ ফুট ৪ ইঞ্চি। জেনারেল ক্যানিংহাম লিখেছেন ‘‘ইহা প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নিদর্শন।’’ সুলতান আলাউদ্দীন খিলজীর সমসাময়িক স্থাপত্য নিদর্শন বলে তিনি অনুমান করেছেন। তিনি আরো অনুমান করেছেন যে, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর মৃত্যুর পর লখনৌতিতে দিল্লীর আধিপত্য কায়েম হলে এই সুদৃশ্য নগর বেষ্টণী প্রাচীর ও তোরণটি নির্মিত হয়।’’ এ মত মেনে নিলে ১২২৯ (হিজরী ৬২৭) খ্রিস্টাব্দের কিছু পর এটি নির্মিত হয়েছিল বলতে হয়। ডাঃ দানী বলেছেন, ‘‘বঙ্গের সুলতান নাসিরউদ্দিন মহম্মদ শাহের আমলে (পান্ডুয়া হতে গৌড় রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পর) রাজধানীর নগর দ্বার হিসাবে ইহা নির্মিত হয়।’’ এই তোরণের উভয় পার্শ্বে ৬ ফুট বিশিষ্ট বৃত্তাকার দুটি শান্ত্রী ঘর ছিল। সেখানে আগ্নেয়াস্ত্রসহ পাহারারত শান্ত্রী থাকতো। এই তোরণ ও শান্ত্রীঘর দুটিতে বিভিন্ন প্রকার লতাপাতার কারুকার্য ছিল।

 

দাফেউল বালাঃ 

তাহখানা সংলগ্ন পুকুরটির নাম ‘দাফেউল বালা’। এটি খুব মাহাত্মপূর্ণ জলাশয়। কথিত আছে খাসমনে এর পানি পান করলে যে কোন প্রাচীন পীড়া সেরে যায়। এজন্য এ পুকুরের পানি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার নিকট পবিত্র। রোগ-ব্যাধি মুক্ত হওয়ার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই পানি ব্যবহার করেন। বিশেষত উরশের সময় এ পানি নেয়ার জন্য হাজার হাজার লোকের ভিড় হয়ে থাকে। কথিত আছে শাহ নেয়ামতউল্লাহর সময়ে বিশেষ কারণে এ পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ কিংবা অন্য কোন পশু বা জীব-জন্তু এ পানি পান করলেই মারা যেত। শাহ সাহেব কয়েকজন মুরীদসহ এখানে উপস্থিত হন। এবং সকলে মিলে পুকুরের পানি পান করেন। সঙ্গে সঙ্গে পানি ভাল হয়ে যায়।

 

 

দাফেউল বালা

 

বালিয়াদীঘিঃ

রাজা বল্লাল সেন (রাজত্বকাল ১১৫৮-১১৭৯ খ্রিঃ) দীঘিটি খনন করেন। ‘বল্লাল দীঘি’ কালক্রমে ‘‘বালিয়াদীঘি’’ নামে পরিচিত হয়েছে। এছাড়া অনেকে মনে করেন বালুকাময় জলাশয় বলে এর নাম বালুয়াদীঘি। কোতোয়ালী গেট হতে দক্ষিণে এই প্রাচীন দীঘিটি অবস্থিত। খাস খতিয়ান ভুক্ত এ দীঘির আয়াতন ৩৯.৪৮ একর। এক কালে রাজবাড়ী এবং দূর্গে এই দীঘি হতে পানি সরবরাহ করা হতো। দীঘির তলদেশ বালুকাময় থাকায় পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ।

 

বালিয়াদীঘি

 

খঞ্জন দীঘিঃ

খঞ্জন দীঘি গৌড়ের একটি প্রাচীন দীঘি। এই দীঘিকে কেউ কেউ ‘খানিয়া দীঘি’ও বলে থাকে। এককালে এর পানি রক্তের মতো লাল ছিল, রক্ত বা খুন থেকে খানিয়া হয়েছে শোনা যায়। বালিয়াদীঘির পূর্বে এর অবস্থান।

 

কানসাটের জমিদার বাড়ীঃ

শিবগঞ্জ উপজেলা কানসাট একটি প্রাচীন গ্রাম। এখানকার জমিদারদের আদিপুরুষ প্রথমত বগুড়া জেলার ‘কড়ইঝাকৈর’ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। দস্যু সরদারপন্ডিতের অত্যাচারে তারা ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছাতে স্থানান্তরিত হন। পরে তারা নবাবগঞ্জের কানসাটে এসে স্থায়ী হন। সূর্য্যকান্ত, শশীকান্ত ও শীতাংশুকান্ত এই বংশের অধঃস্তন বংশক্রম। প্রজা সাধারণের জন্য এরা কিছু রেখে যেতে পারেননি। এরা মুসলিম বিদ্বেষী জমিদার হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেন। জমিদার কার্য ছাড়াও এরা হাতির বেচাকেনা করতেন। আসামে এদের একটি ‘খেদা’ ছিল। এই জমিদার পরিবারে মুসলিম বিদ্বেষের বহু দৃষ্টান্ত এতদঞ্চলে বিদ্যমান। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় কাগজী পাড়ায় মুসলিম সম্প্রাদায়কে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রের ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সুত্রপাত হয়। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় শ্যামপুর চৌধুরী পরিবারের নেতৃত্বে বাজিতপুর গ্রামের আম্রকাননে প্রায় ১২টি ইউনিয়নের মুসলমান সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে উক্ত ঘটনার জোর প্রতিবাদ জানায় এবং একটি মামলা দায়ের করে। এই মামলায় জমিদার শিতাংশু বাবু হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা অনুমান করে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়কে ডেকে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সাময়িক বিপদ হতে রক্ষা পান।

কানসাটের জমিদার বাড়ী

 

প্রাচীনকালে এখানে কংসহাট্টা নামক রাজার বাড়ী ছিলবলে জানা যায়। তার নামানুসারেই স্থানটির নামকানসাট হয়। আবার অনেকে এর অন্য প্রকার নামকণের কথাও বলে থাকেন। ‘কান+সাট’= কানসাট। সাট অর্থ বন্ধ কর। বঙ্গ অধিকারী রানী স্বর্ণময়ীর রাজধানী ছিল নিকটস্থ পুখুরিয়া গ্রামে। পুখুরিয়া বাগদীপাড়ায় এখনও এর ধ্বংসাবেশেষ দেখা যায়। এই রানীর তোপকামানের শব্দে স্থানীয় লোকের কান বন্ধ করতে হতো। কানসাট নামের উৎপত্তি এভাবেই হয় বলে অনেকের ধারণা।

 

 

তরতীপুরঃ

 

এককালে এই অঞ্চল পাট আমদানি ও রপ্তানির কেন্দ্র ছিল। সহানটি পাগলা নদীর তীরে শিবগঞ্জ হতে প্রায় তিন মাইল দূরে অবস্থিত। কেউ কেউ একে তকতীপুর নামে অভিহিত করেন। এটা হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান। এখানকার গঙ্গাজল হিন্দুদের কাছে সর্বাপেক্ষা পবিত্র। প্রতি বৎসর শ্রীপঞ্চমী উপলক্ষে এই তীর্থ ক্ষেত্রে গঙ্গাস্নানের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও অন্যান্য স্থানের বহু হিন্দু নর-নারী এই তীর্থ ক্ষেত্রে এসে গঙ্গাস্নান করে অশেষ পূণ্য সঞ্চয় করেন। দৈব-দুর্বিপাকে ও অসুখ-বিসুখে এখানকার গঙ্গাজল ব্যবহৃত হয়।

 

শিবগঞ্জ উপজেলা বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনের জন্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করলেও এখানে পর্যটনের বিকাশের জন্য সুপরিকল্পিত কোন অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। পর্যটকদের জন্য উন্নত মানের হোটেল,মোটেল, রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন নিদর্শনের পাশে আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও রাস্তা-ঘাট নির্মাণ/মেরামত সংস্কার করা জরুরী। এছাড়া শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন দর্শনীয়, ঐতিহাসিক, স্থান ও স্থাপনা বিষয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।

 

 

 

 

 

 

 

 

চাঁপাই জামে মসজিদ:

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চাঁপাই গ্রামে প্রাচীন একটি মসজিদ রয়েছে। এটি ৮৯৩ হিজরীতে নির্মিত হয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। আলী ওয়াজ খিজির খাঁন নামক এক ব্যক্তি মসজিদের নির্মাতা বলে মসজিদ গাত্রে প্রাপ্ত লিপি থেকে জানা যায়।

 

 

মহারাজপুর জামে মসজিদ:

 

মোগল আমলের সহাপত্যকলার নিদর্শন সমৃদ্ধ সুন্দর লতা-পাতার কারতকার্য খোদিত একটি প্রাচীন মসজিদ বর্তমান মহারাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে এখনো বিদ্যমান।

 

 

মাঝপাড়া জামে মসজিদ:

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পার্শ্বে মাঝপাড়া গ্রামে গম্বুজ বিশিষ্ট একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। এটি মাঝপাড়া বালিগ্রাম মসজিদ নামে পরিচিত। আনুমানিক ১৭৭৫ খ্রিঃ মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়।

 

 

হযরত বুলন শাহ (রাঃ) মাজার:

 

পীরশাহ আব্দুল মসহুদ নবাবগঞ্জ সদরের আমনুরায় ইসলাম প্রচার করেন। পীরের অপর নাম হযরত বুলন শাহ। আমনুরার পূর্বনাম ছিল ঝিলিম। আমনুরায় দীঘির পাশের্ব এই কামেল পীরের সমাধি রয়েছে।

 

 

সর্ববৃহৎ দূর্গাপুজা (বাইশ পুতুল):

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায় ঠাকুরবাড়ী, জোড়া মঠ, রামসীতা মন্দির প্রভৃতি সহাপত্যকলার নিদর্শন আজও টিকে আছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে অত্র অঞ্চলের সর্ববৃহৎ কালিপুজা হয়ে থাকে যা “বুড়াকালি’’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দূর্গাপুজা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বারঘরিয়া গ্রামে। এখানে সাহেবদের কার্তিক, গনেশ, মীবসহ ২১টি মুর্তি পরিবেষ্টেত দেবী দূর্গা সম্বলিত এ সর্ববৃহৎ দূর্গাপুজা সবার কাছে বাইশপুতুল নামে পরিচিত। উত্তু অনুষ্ঠানে হিন্দু মুসলিম সকল ধর্মের লোকের সমাগম হয়। যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি বিরল দৃষ্টামত।

 

 

মহারাজপুর মঞ্চ:

 

একসময় অত্র এলাকায় বিভিন্ন গোষ্ঠি তাদের সাংস্কৃতিক কার্যত্রুম সহায়ী মঞ্চে পরিবেশনার মাধ্যমে উপসহাপন করত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মরহুম সদর আহম্মদ মিয়ার বাড়ীর আঙিংনায় মহারাজপুর মঞ্চটি আজও বিদ্যমান।

 

 

বারঘরিয়া মঞ্চ:

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বর্ধিষ জনপদ বারঘরিয়া বাজারের নিকটে জমিদারবাড়ীর সামনে পাকা সুসজ্জিত মঞ্চটি এখনো চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনের প্রাক্তন মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মোঃ হারুনুর রশীদ-এর পৃষ্ঠপোষকতায় মঞ্চ ২টি সংস্কারের কাজ হাতে নেয়া হয়। এ মঞ্চ ২টিসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় ভাবে গম্ভীরা, আলকাব, মেয়েলীগীতি, খ্যামটা গান পরিবেশিত হয়। লোকজ সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ উপাদনের ধারক এই চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

 

 

জোড়া মঠ:

 

বিসতৃত বরেন্দ্র ভূমি অধ্যুষিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বতমএধর্মী। এখানকার মানুষ আবহমানকাল থেকে প্রকৃতির সংগে সংগ্রাম করে টিকে আছে। পদ্মা-মহানন্দা-পাগলা নদীর করাল গ্রাসে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাড়ী-ঘর, জায়গা-জমি হারিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের হুজরাপুরে দুটো মঠ বা মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তাই এলাকাবাসীর কাছে এটি “জোড়ামঠ’’ নামে পরিচিত। নবাবগঞ্জ পূর্বে হিন্দুপ্রধান এলাকা ছিল, তখন প্রায় প্রত্যেক পাড়ায় বা গ্রামে বিভিন্ন আকারের মঠ গড়ে উঠেছিল। মঠ দুটি মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।